পঞ্চগড় প্রতিনিধি
সেই ছোট্টবেলা থেকে স্কুল শিক্ষক বাবা আফজাল হোসেনের হাত ধরে জান্নাতারা বেগমের পথচলা। ছয় ভাই বোনদের মধ্েয সবার ছোট ও আদরের হওয়ায় বাবা মেয়ের নাম রাখেন জান্নাতারা। ফুটফুটে সুন্দর আর স্নেহ ভালোবাসার কারণে স্কুলে যাবার বয়স না হলেও বাবা তাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। স্কুল যাবার পথে যেতে যেতে একটি বিষয় জান্নাতারা প্রতিদিনই লক্ষ্য করতেন, বিভিন্ন বয়সী মানুষ তাকে দাঁড়িয়ে সালাম করছেন, আদাব দিচ্ছেন। পরবর্তীতে বড়ভাই আকতার হোসেনও বাবার হাত ধরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। একজন স্কুল শিক্ষক বাবা ও ভাইয়ের প্রতি মানুষের এমন শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলে জান্নাতারাকে। যে করেই হোক তাকেও শিক্ষক হতে হবে। স্থানীয় স্কুলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে হঠাৎই পরিবারের পছন্দের ছেলের সাথে ২০১৫ সালে বসতে হয় বিয়ের পিড়িতে। স্বামী পঞ্চগড় সদর উপজেলার মীরগড় গ্রামের জালালউদ্দীনের ছেলে রুহুল আমীন। রুহুল আমীন পঞ্চগড় চিনিকলের মৌসুমী কর্মচারী পাশাপাশি স্টক ব্যবসায়ী ও চা চাষী। বিয়ের পর স্বামীকে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানালে তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা দেয়। ভর্তি করেন শ্বশুরবাড়ি এলাকা পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া ডিগ্রী কলেজে। এ কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাসও করেন তিনি। নতুন সংসারের ফাঁকে পড়াশোনা বেশ ভালই চলছিল। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার পড়াশোনা আগ্রহ দেখে যতটুকু সম্ভব সহায়তাও করেছে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক পাশ করে আবেদন করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক পদে। প্রথম দফা পেরে না উঠলেও দ্বিতীয় দফায় লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন সে। মনে অনেক আনন্দ। স্বপ্ন পূরণ হয়তো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভাগ্য বিড়ম্বনায় সর্বশেষ শিক্ষক হতে পারেন নি তিনি। হতাশার চাদরে ঢেকে যায় তার জীবন। এরই মধ্যে তার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। স্বামী মেয়ের নাম রাখেন রাফিয়া জান্নাত রোজ। বাড়ির পাশে মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রোজ প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। এদিকে জান্নাতারা তার স্বপ্ন পূরণে স্বেচ্ছাসেবা মূলক কাজে জড়ানোর জন্য একটা পথ খুঁজছিলেন। ২০২২ সাল। মেয়ের পড়াশোনা করার স্কুলে ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচন। জান্নাতারা ভাবে এ নির্বাচন তার স্বপ্ন ক্ষাণিকটা হলেও পূরণ হতে পারে। অভিভাবক সদস্য হিসেবে তিনি প্রার্থী হলেন।
জান্নাতারা বলেন, সমাজের জন্য কল্যাণমূলক কিছু একটা করার জন্য সম্মানজনক একটা প্লার্টফর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবক সদস্য নির্বাচিত হলে কমিটির অন্য সদস্যদের সম্মতিতে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। এখন স্বপ্ন পূরণে তাকে পেরুতে হবে অনেক পথ। স্কুলের সার্বিক উন্নয়ন আর শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি হবার জন্য তিনি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করেন। পেশায় তিনি গৃহিনী হলেও গত একবছরে বিদ্যালয়ের উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। নিয়মিত স্কুল মনিটরিং এর পাশাপাশি জাতীয় দিবস থেকে শুরু করে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৃক্ষরোপণ, মা সমাবেশ, উঠোন বৈঠক, মেধাবী ও বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের পুরস্কার প্রদানসহ সকল অনুষ্ঠানে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। শিক্ষাথীদের বাড়তি আনন্দ দেয়ার জন্য বার্ষিক বনভোজনে নিজে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি নিজের টাকায় দুটো বাসভাড়া করে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হবার জন্য বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের বাহাতি স্পিনার ফারিহা ইসলাম তৃষ্ণা ও বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকে সেই বনভোজনে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যান। শুধু তাই নয়, স্কুলের অফিস কক্ষ সজ্জিত করাতে নিজের টাকায় পর্দা লাগিয়ে দিয়েছেন।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক নূর আজম বলেন, সভাপতি মহোদয় স্কুলের সার্বিক উন্নয়নে সর্বাত্বক সহযোগিতা ও চেষ্টা করছেন। নিয়মিত স্কুলের খোঁজ খবর নেয়ার পাশাপাশি ক্লাস মনিটরিং করছেন। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষার্থী অভিভাবকদের সাথেও যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। প্রতিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থাকছেন।
জান্নাতারার স্বামী রুহুল আমীন বলেন, ছোটবেলা থেকেই তার প্রাথমিক শিক্ষক হবার লক্ষ্য ছিল। ভাগ্য না দুর্ভাগ্য সেটা হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ছোটবেলার সেই স্বপ্ন এখন অন্য পরিচয়ে করার সুযোগটি কাজে লাগাতে চেষ্টা করছে। আমি তাকে একাজে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছি।
সভাপতি জান্নাতারা বেগম বলেন, দেশে অনেক খ্যাতনামা স্কুল আছে। আর এর পেছনে ওইসব স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির চমৎকার কিছু পরিকল্পনা ও নিবিড় সম্পর্ক আছে। আমি সেই সম্পর্ক তৈরী করতে চেষ্টা করছি। স্কুলের উন্নয়নে তিনি যেকোন ত্যাগ স্বীকারে রাজী। তিনি বলেন, শ্বশুরবাড়ি এলাকার স্কুল যদি খ্যাতনামা হয় তবে সেই ইতিহাসের স্বাক্ষী হওয়াও অনেক গর্বের। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের কাছে এখন তিনি সভাপতি আপা নামে বেশ জনপ্রিয়।