স্টাফ রিপোর্টার:মোঃ মিজানুর রহমান। একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একদল একদল খান সেনা তাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সনকার দক্ষিণে খুনিয়া এলাকায় তার ক্ষতবিক্ষত নিথর মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর কেটে গেছে সুদীর্ঘ ৫২ বছর। কিন্তু আজ অবধি তিনি পাননি শহিদ কজেতাব। মিজানুর রহমানের পরিবারও পায়নি কোনো স্বীকৃতি।
দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার সাহাপাড়া এলাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৯ সালে জন্ম হয় মিজানুর রহমানের। তার বাবা আফতাব উদ্দীন শাহ ও মা সবেজা খাতুন। মিজানুর ছিলেন তাদের বড় সন্তান। সেনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। অতঃপর খানসামা পাকেরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করে দিনাজপুর সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েয়ে ভর্তি হন ও ১৯৬৭ সালে উর্ত্তীণ হন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে ডিগ্রি পাস করেন তিনি। দিনাজপুর সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় মিজানুর রহমান ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেই উত্তাল দিনগুলো সম্পর্কে পাল্টাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুর রহমান একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, সে সময় মুসলিম লীগের ব্যাপক তৎপরতা ছিল তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে ছাত্রলীগ। ১৯৬৭ সালে পল্লী উন্নয়ন সংস্থা গড়ে তুলি। মিজানুর রহমানের সক্রিয় ভূমিকা ছিল সেখানে। পরবর্তী সময়ে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। মিজানুর রহমান খুব সাহসী ছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তিনি বেঁচে থাকলে দেশ ও দেশের মানুষ অনেক কিছুই পেতো। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
সনকা নিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা কৃষিবিদ আব্দুল খালেক বলেন, আমি ঢাকায় কৃষি কলেজে পড়ালেখা করেছি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিয়েছি। বিভিন্ন সময়ে যখন বাড়িতে আসতাম তখন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতাম। তখন দেখতাম ছাত্রলীগ নেতা সাহসী মিজানুরের সক্রিয়তা। যুদ্ধ শুরু হলে আমি পরিবার নিয়ে ভারতে আশ্র্য নিই। পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে এলে দেশ পূর্ণগঠনের জন্য তিনটি থানার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। পরে জানতে পারি, মিজানুর রহমানকে পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। আমি ওই সময়ে তার কবর জিয়ারত করেছিলাম।
শহিদ মিজানুর রহমানের ছোট ভাই গণপূর্ত বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী যুদ্ধাহত (গুলিবিদ্ধ) মোঃ মোতালেব হোসেন একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৩ মে আমরা পালিয়ে যাওয়ার পথে পাক হানাদার বাহিনীর সামনে পড়ি। সেখানে সাতজন পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহিদ হন। এছাড়া আমিসহ ছয়জন গুলিবিদ্ধ হই।
মোতালেব হোসেন আরও বলেন, যুদ্ধের সময় আমার বড় ভাই মিজানুর রহমান বাড়িতে থাকতেন না। বিভিন্ন জায়গায় তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করতেন এবং স্থানীয়ভাবে খোজখবর রাখতেন। প্রয়োজন হলে আসতেন। এমনই একদিন ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি সাদা পাঞ্জাবি পড়ে বাড়িতে আসেন। পাঞ্জাবি খুলতেই আমার মা তাকে বলল, তুই কেনে আইসিছ? পালা পালা। খানগুলা এখনই আসিবে তোক ধরিবা। ভাই তখন বলল, আসুক, ধুরুক। মোর রক্ত না দেওয়া পযর্ন্ত দেশ স্বাধীন হবেনা। তাদের কথোপকথনের এক পর্যায়ে অস্ত্র-সস্ত্র হাতে একদল খান সেনা এসে হাজির হয়। তাকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন সেনগ্রামের আকাশে একটি হেলিকপ্টার ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে রাউন্ড দিতে দেখা যায়। ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আমাদের পরিবার ও এলাকাবাসী অনেক খোজাখুজির পর ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সনকার দক্ষিনে খুনিয়ায় শহিদ মিজানুর রহমানের ক্ষতবিক্ষত নিথর মৃতদেহ পাওয়া যায়। এরপর তার মৃতদেহ সেনগ্রাম সাহাপাড়ায় আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর এখন পর্যন্ত তার নামের পাশে শহিদ খেতাব রাষ্ট্রীয় ভাবে রচিত হয়নি। আমরা পাইনি শহিদ পরিবারের স্বীকৃতি। তাই মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে আকুল আবেদন, আমাদের মিজানুর রহমানকে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেওয়া হোক।