শহীদুল ইসলাম শহীদ, পঞ্চগড়।। ২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের অধীনে বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত ইউনিটটি বন্য প্রাণী উদ্ধার করেছে ৩৬ হাজারের বেশি। বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের অধীনে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট মামলা হয়েছে ১৪টি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে নয়টি। বছরটিতে মোট অপরাধীর সংখ্যা ছিল ২৮ জন। বন্য প্রাণী সংক্রান্ত মোট অপরাধ ঘটেছে ৫৪৯টি। জব্দ করা মোট প্রাণী ছিল ৩ হাজার ৭৮৫টি। জব্দ করা মোট ট্রফি ছিল ১৬৯টি। দুটি বিনোদনমূলক পার্ক ও মিনি চিড়িয়াখানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে সবই পাচার বা অপরাধীর হাত থেকে উদ্ধার নয়, এর মধ্যে বাড়ি থেকে সাপ উদ্ধারসহ লোকালয়ে চলে আসা বন্য প্রাণী রয়েছে। এ পর্যন্ত পাখি উদ্ধার করা হয় ২৭ হাজারের বেশি। স্তন্যপায়ী প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে ৭০০টি।
এ ইউনিটের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে দেশের বন্য প্রাণী ফরেনসিক ল্যাবটিও। কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবল ও উদ্ধার সরঞ্জামের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে ২০১৬ সাল থেকে চলতে হচ্ছে ইউনিট ও ল্যাবটিকে।
বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের কাজের তালিকাটা ব্যাপক। বন্য প্রাণীর পাচার রোধ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ, সারা দেশে হটস্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত টহল, বন্য প্রাণীর বাণিজ্য রোধে হাটবাজার ও পাখিসমৃদ্ধ এলাকায় নিয়মিত টহল, বন্য প্রাণী থেকে নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, পাচারের সময় আটক করা বন্য প্রাণীর দেহাবশেষ বা ট্রফি থেকে প্রজাতি শনাক্তকরণ, অপরাধের মূল তথ্য উদ্ঘাটন ও অপরাধীকে শনাক্তকরণ, বন্য প্রাণী উদ্ধার করে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্তকরণ, আহত বা অসুস্থ বন্য প্রাণীর পরিচর্যা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, বন্য প্রাণী অপরাধ সম্পর্কিত কার্যকর ডেটাবেইস তৈরি করা, স্বেচ্ছাসেবী ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করার কথা এ ইউনিটের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গুরুত্বপূর্ণ ৬/৭ মাত্র জনকে নিয়ে চলছে দেশের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। তবে ইউনিটটি এখনো রাজস্ব খাতেও আওতায় আনা হয়নি। নেই কোন পর্যাপ্ত বরাদ্দ।
বন্য প্রাণী অপরাধ দমনের জন্য ২০১২ সালের জুলাই মাসে স্ট্রেনদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন প্রকল্পের আওতায় ইউনিটটি কাগজে-কলমে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও আবাসস্থল উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ইউনিটটি পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৫ সালে ইউনিটের কার্যক্রম মহাখালীর বন ভবন থেকে আগারগাঁওয়ে বন ভবনের সপ্তম তলায় স্থানান্তর করা হয়।
ইউনিট ও ল্যাবে কর্মরত ব্যক্তিরা জানালেন, ইউনিটের উদ্ধার বা জব্দ করা বন্য প্রাণী পরিবহনের জন্য গাড়ি ও গাড়ির চালক নেই। নেই পর্যাপ্ত উদ্ধার সরঞ্জাম। উদ্ধার বা জব্দ করা বন্য প্রাণীকে সাময়িকভাবে রেখে পরিচর্যা ও চিকিৎসা করার জন্য রেসকিউ সেন্টার নেই। ইউনিটের জন্য এখন পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট হটলাইন নম্বর নেই। কর্মকর্তা, কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই। উদ্ধার করা আহত বা অসুস্থ বন্য প্রাণীর চিকিৎসায় পশু চিকিৎসকও নেই। ফরেনসিক ল্যাবেও আছে যন্ত্রপাতির সংকট। বন্য প্রাণীর ডিএনএ প্রোফাইল, ডিএনএর মাধ্যমে সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে ফৌজদারি অপরাধ শনাক্ত করে ফৌজদারি প্রমাণ হেফাজতে রাখার পাশাপাশি আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে এ ল্যাবের মাধ্যমে।
ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্লাহ পাটোয়ারী জানালেন, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৯টি মামলার বিভিন্ন আলামত ফরেনসিক ল্যাবে এসেছে। ১২টি আলামতের কাজ নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ছাড়া নয়টি আলামতের ক্ষেত্রে বন্য প্রাণীসংক্রান্ত অপরাধ হয়নি। এর পাশাপাশি সারা দেশের বন্য প্রাণীর ডেটাবেইস বা জেনেটিক ডেটাব্যাংক তৈরির কাজ চলছে ফরেনসিক ল্যাবে। বর্তমানে দুজন কর্মকর্তা ল্যাব সামলাচ্ছেন। ইউনিটটি এখনও রাজস্ব খাতেও আওতায় আনা হয়নি। নেই কোন পর্যাপ্ত বরাদ্দ।
ফরেনসিক ল্যাবে পাওয়া ফলাফল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সহায়তা করছে। তবে ল্যাবের কাজে কোনোটির ফলাফল পেতে তিন মাস, আবার ছয় মাসও লেগে যেতে পারে উল্লেখ করে মো. ছানাউল্লাহ পাটোয়ারী বলেন, বন্য প্রাণী বা সহজ করে বললে বলা যায়, হরিণের মাংস জব্দ করা হয়েছে, তবে তা আসলেই হরিণের মাংস কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যই ল্যাবের ফলাফল জরুরি ভূমিকা রাখছে। মৃগনাভি জব্দ করা হলো, তবে পরীক্ষায় দেখা যায় তা মৃগনাভি নয়, কৃত্রিম কিছু একটা পাচারের জন্য নেওয়া হচ্ছিল। এসব ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীরা সাজা পাচ্ছে দ্রুত, অপরাধীদের মনে ভয়ও কাজ করছে।
বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক জানান, গরম হোক বা শীত হোক কিছু অসাধু পাখি শিকারী আইন অমান্য করে পাখি শিকার করে। বিশেষ করে, শীত মৌসুমে বিপুল সংখ্যক অতিথি পাখি এদেশে আসে। তাদের লক্ষ্য করে পাখি শিকারি চক্রের সদস্যরা অতিথি পাখি শিকার করে। শুধু পাখি নয় বণ্যপ্রাণী ও পাখি শিকারীদের জন্য আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং পাখি শিকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলায় শুক্রবার সকালে তড়েয়া ইউনিয়নের দাড়খোড় গ্রামের পাশে নাগর নদীতে জাল দিয়ে ধরে পিটিয়ে একটি চিতা বাঘকে গ্রামবাসীরা মেরে ফেলে। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। স্থানীয় বনবিভাগের কর্মকর্তা মধুসুধন বর্মন এই চিতা বাঘটিকে হত্যার ঘটনাটি দায় ও ঝামেলা এড়াতে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বোদা উপজেলার রহমতপুর গ্রামে পুলিশ ও বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সামনেই গ্রামবাসীরা একটি চিতা বাঘকে পিটিয়ে হত্যা করে। নীলফামারীতেও পিটিয়ে একটি চিতা বাঘকে হত্যা করা হয়। এর আগে তেঁতুলিয়াতেও তৎকালীন বিডিআর গুলি করে একটি চিতা বাঘকে হত্যা করে। অনেক আগের কথা ভারত থেকে আসা একটি গন্ডারকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তৎকালীন বিডিআর এটি আবার ভারতে ফেরত পাঠায়। এসব ঘটনায় কোন মামলা বা সাজার ঘটনা নেই। ফলে এমন অপরাধ বাড়ছে।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক বলেন, আমরা তদন্ত দলটি দিনব্যাপী ঘটনাস্থল পরির্দশন করে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ, প্রশাসন ও বিজিবি, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছি। চিতা বাঘটির মৃত্যুর বিষয়ে আমরা নানান তথ্য পেয়েছি। এসব তথ্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশমালাসহ পেশ করা হবে।
বন্যপ্রাণীপ্রেমী ও আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ জানান, আইনের প্রয়োগ ও এসব এলাকায় ব্যাপক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সেটা বনবিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন বা অন্য কোন সংস্থা নিতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ পরিষদ (বেলার) রাজশাহী-রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী তম্ময় শ্যানাল বলেন, বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের প্রয়োগ ও ব্যাপক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। এসব ঘটনায় বনবিভাগকে মামলা করতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পঞ্চগড় আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক আজারুল ইসলাম জুয়েল বলেন, সুন্দরবন অঞ্চলে যেমন টাইগার রেসপন্স টিম কিংবা গারো পাহাড় অঞ্চলে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম কাজ করে, এখানে তেমনি ল্যাপার্ড রেসপন্স টিম গঠন করা যেতে পারে, যারা সাধারণ মানুষকে চিতা বাঘ দেখলেই মেরে না ফেলার ব্যাপারে সচেতন করবেন। তেমনি লোকালয়ে চিতা বাঘ দেখা গেলে এদের সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে দিতে কাজ করবে। আইনের প্রয়োগ ও মানুষকে সচেতন করাই একমাত্র উপায়। চিতা বাঘ দেখা গেলেই যেন বন বিভাগকে জানানো হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
দিনাজপুর বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. বশিরুল-আলম-মামুন মুঠোফোনে বনবিভাগের সীমাদ্ধতার কথা তুলে ধরে বলেন, ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ করতে হবে। ইতোমধ্যে আমারা ঠাকুরগাঁয়ের দুটি ঘটনায় মামলা করেছি।
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্লাহ পাটোয়ারী মুঠোফোনে বলেন, জনবল প্রয়োজনীয় ও অর্থ সংকটের মধ্যেও ইউনিটটি কাজ করে যাচ্ছে। আটোয়ারীতে চিতা বাঘ হত্যার ঘটনা তদন্তে একটি টীম পাঠানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। #