শহীদুল ইসলাম শহীদ,পঞ্চগড়।।পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় কৃষকের গম ক্ষেতসহ পেঁযাজ, আলু ও মরিচ ক্ষেতে ট্রাক্টর দিয়ে হাল চাষ করে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। চাষিরা বলছেন বেশ কিছুদিন থেকে ল্যান্ডকো নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের নাম করে এই এলাকার তিন ফসলী জমিতে চাষ করা আবাদ ভেঙ্গে জোর করে জমি দখল করছে। এতে চাষিদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
অভিযোগ উঠেছে তিন ফসলী জমিতে শিল্পকারখানা স্থাপনে সরকারের কড়া নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কোন কিছুই তোয়াক্কা করছেনা ল্যান্ডকো নামের ঢাকার ওই প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠান উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের শেখগছ গ্রামে পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের নাম করে জমি ক্রয় করেছেন।
সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, তিন ফসলী এসব জমিতে গম,ভুট্টা, মরিচ, বাদাম, ধান, পেঁয়াজসহ নানা ধরণের আবাদ রয়েছে। প্রতিবছর এসব জমি থেকে কয়েক হাজার টন ফসল উৎপাদন হয়। এছাড়া বর্ষাকালে কয়েক হাজার টন দেশি মাছ উৎপাদিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে এই এলাকায় পাওয়ার প্লান্ট প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় কিছু জমি কেনা বেচার দালালদের মাধ্যমে জমি ক্রয় শুরু করে ওই প্রতিষ্ঠানটি। ওই প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বলছেন গত কয়েক বছরে তারা এই এলাকায় ২৭৬ একর জমি ক্রয় করেছেন। এর মধ্যে ৫০ একর জমি তাদের দখলে রয়েছে। বর্তমানে বাকি জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এদিকে জমি বিক্রি না করলেও প্রতিষ্ঠানটি কৃষকের ফসলি জমি ও গাছপালা কেটে বাড়িঘর ভেঙ্গে জমি দখলে নেয়ার চেষ্টাও চালাচ্ছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেন । এনিয়ে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে দেয়া হচ্ছে হুমকি ও মামলা। ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
৫ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) দুপুরে ৩টি ট্রাক্টর ও দুই আড়াইশ ভাডাটে লোকজন নিয়ে জমি দখলে নিতে আসে প্রতিষ্ঠানটির লোকজন। এসময় বাকবিতন্ডা শুরু হলে একপর্যায়ে বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, তেঁতুলিয়া মডেল থানা পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাহবুবুল হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। কমিটির অন্য দুজন সদস্য হলেন উপজেলা সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার, কৃষি কর্মকর্তা। কিন্তু গত ২০ দিনেও তদন্ত শেষ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতিপূরণের আশায় দপ্তরে দপ্তরে ঘুরছেন।
দশে চলমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে মৌসুমী কৃষি খামার প্রকল্প নামে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সোলার পাওয়ার প্লাট স্থাপনে ২০১৭ সাল থেকে ল্যান্ডকো সোলার পাওয়ার প্লান্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের শেখগছ গ্রামে ২৭৬ একর জমি ক্রয় শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি বুঝে না পাওয়া জমি দখলে নিতে গেলে বিরোধে জড়ায় উভয়পক্ষ। এতে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছে উভয়পক্ষ। আর এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার বিদ্যুৎ চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কাছে অনেক আগেই জমি বিক্রির পর তা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাঝে তারা সেই জমি বাদ দিয়ে অন্য ফসলি জমি দখল করার চেষ্টা করছে।
প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিধিরা বলছে, স্থানীয় দালালচক্রের মাধ্যমে জমি দাতারা ভুয়া খারিজসহ প্রতারণায় একাধিকবার জমি বিক্রি করে প্রাপ্ত জমি আটকে দিয়েছে। তাদের নানা কৌশলে অনিয়ম ও প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা। এতে ৩ বছরের প্রজেক্ট শেষ হচ্ছে না ৬ বছরেও। অভিযোগের বিষয়ে আবারও স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি অস্বীকার করেন তারা।
‘স্থানীয় মরহুম হারুন প্রধান একটি চক্রকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে জমি ক্রয় শুরু করে। এর মাঝে স্থানীয় ইব্রাহিম, মিজানুর রহমান ও শিবলী সাদিকসহ অন্যদের নিয়ে ভুয়া খারিজ তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে এক জমি একাধিকবার প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিক্রি করে। বিষয়টি জানার পর সঠিক জমি নিতে গেলে এখন তারা বিভিন্ন ভাবে বাধা দিচ্ছে। আমাদের ভরাট করা পুকুর জমি ফেলে না রেখে তাদের চাষাবাদ করতে দেয়া হয়। এখন দাবি করছে তারা জমি বিক্রি করেনি। অসাধু উপায় অবলম্বন করে বিক্রিত জমি বুঝিয়ে দিচ্ছেন না দাতারা।’
ভুয়া খারিজের বিষয়ে মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা সঠিক দলিল দিয়ে জমি বিক্রি করে তাদের পাওনা জমি বুঝিয়ে দিয়েছি। যে অভিযোগ করছে সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। এখন তারা আমাদের অন্য জমি দখলের চেষ্টা করছে। আমরা এর সুষ্ঠু সমাধান চাই।’ হারুন প্রধান ল্যান্ডকোর দায়ের করা মামলায় দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। সম্প্রতি তাঁর কারাগারেই মৃত্যু হয়।
শিবলী সাদিক বলেন, ‘আমি তাদের কাছে জমি বিক্রি করেছি। এখন তারা অভিযোগ করছে আরও জমি পাবে। যদি জমি পায় তাহলে সঠিক নিয়মে আমি তাদের পাওনা বুঝিয়ে দেব।’ ইব্রাহীম, ওবাইদুল ইসলাম ও সেরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে একই কথা বলেন তারা।
স্থানীয় কৃষক মোস্তফা কামাল বলেন, প্রতিষ্ঠানটি যদি কারো জমি কিনে থাকে তাহলে তারা দখল করবে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তারা গণহারে কেন জমি দখল করবে। কেউ জমি বিক্রি না করলেও মানুষের ফসলের উপর ট্রাক্টর চালিয়ে জমি দখল করছে। গত কয়েকদিন আগেও তারা আমাদের গমসহ নানা ফসলের আবাদ নষ্ট করেছে। মখলেছা বেগম নামে স্থানীয় এক নারী বলেন, কোম্পানীর লোকজন কিছুদিন আগে আমার বাড়ি ভিটার গাছ কেটে বাড়ির সীমানা বেড়া ভেঙ্গে ফেলছে। আমি জমি বিক্রি করিনি। তবুও তারা বলছে জমি আমাদের লাগবে। আমরা অন্যত্র আপনাকে বদল দিবো। আমি গরীব মানুষ কোথায় যাবো? স্বামী, সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে সংসার চালাই।
প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় প্রতিনিধি জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, ‘আমরা প্রথমে আমাদের ২৭৬ একর জমি দখলে নিয়ে সীমানা ঘেরা দিতে চাচ্ছি। তবে এর মধ্যে যদি কারো জমি পড়ে থাকে তাহলে তাকে আমরা প্রথমে বিক্রি করতে অনুরোধ করছি। নতুবা তাকে আমরা অন্যত্র জমি বদল দিবো। তবে অনেকে ভূয়া দাতা সেজে জমির মালিকানা দাবি করছে। সেই সাথে বিভিন্ন মহলের ইন্ধনে তারা বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টাও করছে। আমরা ফসলহানি করলেও এর ক্ষতিপূরণ দিবো।’
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি বলেন, ‘জমি বিক্রি না করলেও স্থানীয়দের ফসলি জমি দখল করে নেয়া হচ্ছে এমন খবর পেয়ে তেঁতুলিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ ঘটনাস্থলে যাই। তবে কৃষকদের কেউ জমি বিক্রি না করলে তাদের জমি কেউ দখলে নিতে পারবেনা। এ ঘটনায় সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে সেটেলম্যান্ট অফিসার, কৃষি অফিসারকে সদস্য করা হয়েছে। কমিটি জমির মালিকানা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করে রির্পোট দিলেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই সময়টিতে উভয় পক্ষকে নালিশি জমিতে না যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।’
তদন্ত কমিটির প্রধান তেঁতুলিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাহবুবুল হাসান বলেন, ১২শ দাগ রয়েছে। তদন্তে একটু সময় লাগবে। তবে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করা হবে। #