।। শফিক পারভেজ পরাগ।।
আজ ভোরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের সেই বহুল আলোচিত, সমালোচিত মানুষটি—রাজ্জাক, যিনি সাধারণভাবে পরিচিত ছিলেন ‘রাজ্জাক চোর’ নামে।
তিনি মোটরসাইকেল চুরি করতেন। হ্যাঁ, তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আছে। বারবার ধরা পড়েছেন, গণপিটুনিও খেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো–একজন মানুষ যিনি এতবার ধরা পড়ার পরও আইনের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হননি, বরং জামিনে বের হয়ে আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়লেন, সেই দায় কার?
তিনি এক সময় পৌর কমিশনার ছিলেন–জনগণের ভোটে নির্বাচিত। চোর হয়েও জনপ্রতিনিধি–এই বাস্তবতা আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও মূল্যবোধের কতটা দেউলিয়াত্বের ইঙ্গিত দেয়?
রাজ্জাক মোটরসাইকেল চুরি করতেন, তারপর টাকা নিয়ে তা ফেরত দিতেন। একটি গোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। সমাজে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল, আবার ভয়ও ছিল। আর আমরা সবাই জেনে-শুনেও চুপ ছিলাম।
শেষ পর্যন্ত, পীরগঞ্জে তাকে আবারও ধরা হয়। কিন্তু এবার আর পুলিশ নয়—জনগণই ‘বিচারক’ হয়ে উঠলো। গণপিটুনি চললো, আর শেষ পর্যন্ত সেই পিটুনির জখমেই তার মৃত্যু হলো।
প্রশ্ন হলো—এ মৃত্যু কী ন্যায়বিচার? একজন চোরের মৃত্যুতে কি সমাজ থেকে অন্যায় মুছে যাবে?
না। বরং এই মৃত্যু আমাদের আইন, মানবতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয়।
আমরা আজ এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে বিচার পাওয়া যায় না, আর বিচারের নামে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। গণপিটুনি যেন উৎসবে রূপ নেয়—ভিডিও হয়, ছড়িয়ে পড়ে, আর কিছুক্ষণ পরে আমরা আরেকটি খবরের খোরাক খুঁজি।
রাজ্জাকের মৃত্যু কোনো সমাধান নয়, বরং এটি আরও গভীর এক অসুখের লক্ষণ।
সত্যি বলতে, রাজ্জাক আমাদেরই তৈরি।
আমাদের দুর্বল বিচারব্যবস্থা, আমাদের নীরব সমাজ, আমাদের মুনাফামুখী রাজনীতি, আমাদের সহনশীলতার অভাব—এসবই তাকে এমন করেছে। আজ রাজ্জাক নেই, কিন্তু রাজ্জাকের জন্মদাতা সমাজ এখনো রয়ে গেছে—আরও অনেক রাজ্জাকের জন্য উপযুক্ত মাটি তৈরি করে রেখেছে।
আমরা কি আদৌ ভাববো, বদলাবো, না শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেই যাবো?