আমাদের বাসায় অপূর্বসব গানের সংগ্রহ ছিল।উত্তম কুমারের “আনন্দ আশ্রম’ ছবিতে কিশোর কুমারের কণ্ঠে একটা গান ছিল, ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে।” ছবির কিছু সংলাপসহ গানটা রেকর্ডিং করা ছিল। উত্তম কুমারের কণ্ঠের ওঠানামা বিদায়ের সময়কে বিষণ্ণ করে দিতো। কত বৃষ্টির দিন ভেজা ভেজা বাতাসের মুখোমুখি বসে আমরা সুরের মোহজালে জড়িয়ে যেতাম ।
গানশুনা আর বই পড়া আমার পিতৃ-মাতৃ উভয়কূলে নেশা ধরানো ছিল। আমার বাবা তো ছিল পাড় মাতাল পাঠক। ভূমিকম্প হলেও প্রাণ বাঁচাতেও বাবা বই হাত ছাড়া করবেন না। আমার বাবার হাতে বই -পত্রিকা যেন আগে চলে না যায় তাই আমরা যে যেখানেই পারতাম বই লুকিয়ে রাখতাম।সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল ড্রয়িং রুমে বিছানো ফ্লোর ম্যাটের নীচে। আর মা যেমন বই পড়তেন তেমনই ছিল রাজনীতি সচেতন। পৃথিবীর সব সংবাদই আমার মায়ের শুনতেই হবে।বিবিসি/ভয়েস অব আমেরিকা না শুনে আম্মা মনেহয় কখনওই ঘুমায়নি। আম্মা সবসময়ই যার বাসায় যেই পত্রিকাই রাখা হতো, সেগুলির সমঝদার পাঠক ছিলেন।দেশ, অমৃতবাজার, বেগম, ঝিনুক আর ঈদ সংখ্যা সবই পড়তেন তাই বই/পত্রিকা নিয়ে বোনে বোনে পাল্লা দেবার চেয়ে আম্মা -আব্বার সাথেই আমাদের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন চলতো বেশি — বই /পত্রিকার দখল কার কাছে থাকবে! আব্বা রিডার ডাইজেস্ট পড়তেন সবসময়ই।দারুণ দারুণ ইংরেজি বই।ইংলিশ বইর পৃষ্ঠা এবং কাভারপেইজ এতটাই আকর্ষণীয় ছিল শৈশবে আমাদের কাছে, মাঝে মাঝে ব্লেড দিয়ে কেটে নিজের মালিকানায় রাখতাম। আমার বাবা হৈচৈ করে বাসা মাথায় তুলতেন। সেই জীবনে তো জানতাম না কত বড় অপরাধ করেছি!! একটুতেই মনে কষ্ট হতো।কত অভিমনে চোখে জল ঝরিয়েছি।
আজও একা শুয়ে ভাবি ইবসেনের “ডলস হাউজ”র নায়িকা নোরার ব্যাক্তিত্বময় চরিত্রের পরিমিতি, অহংবোধ মেজপার কাছে শুনে ভাবতাম, আমিও নোরার মতো সমাজের অসঙ্গতিকে অতিক্রম করে স্বাধীন জীবন যাপন করব।
আমার মেজ আপার মুখখানা গোধূলি বেলার অস্তগামী সূর্যের বিষণ্ণ আকাশ জুড়ে বারবার ভেসে উঠে।
জানালার পাশে বসে ওই দূরের ইট বিছানো মাটির রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেঁটে আসা তরুণদের কত নামে চিনতাম। এক লোক নধর শরীর এলিয়ে রিকশায় বসতেন, আমরা বোনেরা নাম দিলাম, আলালের ঘরের দুলাল, কেরোসিনের ব্যবসা ছিল তাই নাম ছিল কেরোসিন ওয়ালা।ভুড়িওয়ালা, মোটকা, বিমানে চাকরি করতেন বিমান, রাত সাড়ে নয়টা -দশটায় দুই তরুণ রাতের নির্জনতা খান খান করে দিতো।প্রচণ্ড জোরে হোন্ডা চালিয়ে যেতো, হর্ন বাজিয়ে খালি রাস্তায় তারুণ্যের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দিয়ে যেতো। আরও কত চমত্কার স্মৃতি। আলো আঁধারে ব্যালকনিতে একাকী দাঁড়িয়ে আবছায়াতে প্রিয় মানুষ দেখতে কেন জানি খুব রোমাঞ্চকর মনে হতো। আমাদের বাসার অদূরেই শৈলবালাদের বাড়ির পাশে লাল কৃষ্ণচূড়া আমার খুব প্রিয় ছিল। বৃষ্টির দিনে ভেজা কৃষ্ণচূড়া আজও আমাকে দুর্বল করে দেয়। আর স্মৃতিময় করে দেয় আছমাদের বাসার সামনে থাকা হাস্নাহেনা ফুলের সুবাস।
সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে।চতুর্দিকে দেশ গড়ার মহা পরিকল্পনা। আমাদের ওয়াসা কলোনিতেও সবুজ বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছে।চতুর্দিকে নারিকেল গাছ, অরহর ডাল, মেস্টা (টক জাতীয় গাছ) পেয়ারা কূল আতা জাম গাছ লাগানো হল। আমাদের মতো পাশের বিল্ডিং এর সাজুরাও ছিল তখন সাত বোন। ওদের বাসায় ওদের চাচা/মামারা অনেকেই থাকতেন।ওদের চাচা তাই আমরাও চাচা ডাকতাম। যুদ্ধের পর বদরুল চাচা উঁচু উঁচু টিলার ঝোপঝাড় আমাদের নিয়ে পরিষ্কার করে ফেললেন।
আমরা মহা উৎসাহে চাচার সঙ্গী হয়ে কিছু ভূখণ্ড চাষাবাদের দখল পেলাম। আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল রুশো। ও আর আমি মিলে মাটি কুপিয়ে করলা ঝিঙা ঢেড়শের বীজ বুনলাম। সন্ধ্যা হলে পানি দেই, সকাল হলেই দেখতে যাই। বাঁশ পুতি, রশি দিয়ে সীমানা টানাই আর দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বদরুল চাচা আর মায়া চাচার কাণ্ড কারখানা দেখি। ওনারা তখন হাঁস-মুরগি পালনও শুরু করেছেন। হাঁস -মুরগির জন্য একটা বড় কাঠ এবং নেট দিয়ে খোয়াড় তৈরি করেছেন। আমরা ওনাদের পিছনে পিছনে হাঁটি অবাক বিস্ময়ে দেখি। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন কিন্তু সবসময়ই হাসিমুখ।
কদিন পর বদরুল চাচা খরগোশ কিনে আনলেন।শুনেছিলাম আগের জন্মে বুদ্ধ হাঁস হয়ে জন্মেছিলেন, তাই বোধহয় হাতের ভিতরে খরগোশের নরম তুলতুলে শরীর ছুঁয়ে আমার কেমন জানি যীশু যীশু লাগতো।
খুব পবিত্র মুখ আর চাহনি।
একদিন রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আমার বুকের ভিতরে চাপ চাপ মাটি ভেঙে পড়ছে। আমাদের সাজানো বাগান? শৈশবের নানাবাড়িতে থাকাকালীন রাধাবল্লভ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রচণ্ড স্লোতস্বিনী মেঘনার খাল পাড়ি দিয়ে বাঁশের সাঁকো উপর দিয়ে দুরু দুরু বক্ষে দোআ দুরুদ পড়তে পড়তে সাঁকো পার হতাম। তখন দেখেছি ধড়াশ করে চাপ চাপ মাটি ভেঙে পড়ে। প্রবল বৃষ্টি আমার মনের ভিতরে বিষণ্ণতার ছাই রঙ ছাপিয়ে যায়, মাটির ধ্বসে যাওয়ার শব্দ হিস হিস করে বুকের ভিতরে ভাঙন নামে। (ক্রমশ)