স্টাফ রিপোর্টার ।। সড়কপথে ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং যাত্রীদের যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট পঞ্চগড়র বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। উত্তরাঞ্চলের এ বন্দর দিন দিন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দাপ্তরিক কার্যক্রম, রাজস্ব আদায় প্রায় সব বিষয়েই অনিয়ম স্বাভাবিক ঘটনা। রাজস্ব কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সরকার বন্দরটি দিয়ে রাজস্ব হারাচ্ছে।
বন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর সঙ্গে বন্দরের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবেদনে বন্দরের চিত্র অনেকাংশে উঠে এসেছে বলে মনে করে তারা। স্থলবন্দরের বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। অপ্রতুল নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বন্দর ও কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় প্রায়শই বিনা শুল্কে আমদানিকৃত মালামাল বের করে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।
চাঁদাবাজ-সিন্ডিকেটে জিম্মি দেশের অন্যতম বৃহত্তম বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। একইসঙ্গে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জৌলুস হারাচ্ছে বন্দরটি। সব সেক্টরে এ অরাজকতার কারণে দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা এ বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিদেশ গমনকারীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দর দিয়ে ত্রিদেশীয় বাণিজ্য বাড়ার সুযোগ থাকলেও শুল্ক আদায়ে লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে সরকার রাজস্ব বেশি পাবে এমন পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নেপালের সাথে এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়। পরে শুল্ক স্টেশনটিকে স্থলবন্দর ঘোষণা পরে ভারত ও ভুটানের সাথেও এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপবÍানি কার্যক্রম শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের একমাত্র এ বন্দরটির সঙ্গে বাংলাদেশের ত্রিদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। এ পথে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, ভুটান ও নেপালের ব্যবসা হয়। তাই বন্দরটি মূলত ত্রিদেশীয় বন্দর হিসেবে স্বীকৃত।
স্থলবন্দরটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের একটি সিন্ডিকেট তাদের মতো করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছে। এখন কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, আমদানি-রপ্তানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে চলছে রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসব। সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ের অর্জিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না।
একাধিক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অভিযোগ করে বলে, বর্তমানে এ বন্দরে রাজস্ব কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো শুল্ক কর্তৃপক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা না করা। পাথর ছাড়া কোনো পণ্য আমদানি করা হলে কাস্টমস কর্মকর্তারা সহযোগিতা না করে উল্টো হয়রানি করেন। নির্দিষ্ট অংকের টাকা ঘুষ না দিলে দিনের পর দিন পড়ে থাকে গাড়ি। শেষ পর্যন্ত কোনো রকমে মালামাল ছাড় করা গেলেও ভুক্তভোগীরা পরে এ বন্দর আর ব্যবহার করতে চান না।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সায়েদুজ্জামান বলেন, দিনের পর দিন হয়রানিতে আমরা অতিষ্ঠ। সরকারের রাজস্ব আদায় বেশি হয় এমন পণ্য (ইমিটেশন, কাপড়, মসলা, জিরা, চা-পাতা, মোটর পার্টস, ইলেকট্রিক সরঞ্জাম) এ বন্দর দিয়ে নিয়ে এলেই খুলে যায় কাস্টমসের হয়রানির খাতা। যাচাই-বাছাইয়ের নামে তারা মালামাল ফেলে রাখে দীর্ঘ সময়। আবার চাহিদামতো ঘুস দিলে ফাইল দৌড়ায় বিদ্যুৎগতিতে। নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত ভ্যালু ট্যাক্স আদায়ের বিষয়তো রয়েছেই।
কাস্টমসের সহকারী কমিশনার থেকে শুরু করে ইন্সপেক্টর পর্যায়ের অফিসাররা এই অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। আমরা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানালে তারা সরাসরি বলে ‘রাজস্ব যা আদায় হয় হোক, আমরা ভাগ ঠিকমতো না পেলে ফাইল ছাড়া হবে না। নানা প্রক্রিয়ায় বন্দরের বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। সরকারি রাজস্ব সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর ব্যক্তিগত আয়ের উৎস পরিণত হয়েছে।’
তবে বন্দর কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিক আহমদ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের একটি অংশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অনৈতিক কাজে জড়িত। এরা অতিরিক্ত সুবিধা না পেলে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ করেন।
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, তার অধীনস্ত কিছু কর্মকর্তা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নেন। এটা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ও ভারতের ফুলবাড়ি স্থলবন্দরে যৌথ শক্তিশালী আন্তঃদেশীয় একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে উভয় দেশের সিন্ডিকেট সদস্যরা আমদানি-রপ্তানি করে রাজস্ব ফাঁকির টাকা নিয়মিত ভাগবাটোয়ারা করে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের বেশ কিছু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট দীর্ঘদিন এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।
প্রথমে একটি আমদানিকৃত পণ্যের ট্রাক বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে প্রবেশের পর বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ হয়ে নির্ধারিত ওজন স্টেশনে নেওয়া হয়। সেখানে কম্পিউটার পদ্ধতির মাধ্যমে ওজন পরীক্ষা করা হয়। সরকারি বিধিমোতাবেক ওজন স্টেশনে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টমস, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লোকজন উপস্থিত থাকেন। এখানেই সমঝোতার ভিত্তিতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমদানি করা পণ্যের ওজন ফাঁকি দিয়ে কম দেখানো হয়। এরপর আমদানি করা পণ্যের ওপর কাস্টমস কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত বিল অব এন্ট্রি প্রস্তুত করে উপস্থাপন করে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই অতিরিক্ত পণ্যের রাজস্ব ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়। অতিরিক্ত পণ্যের লোডিং-আনলোডিং কার্যক্রমের চার্জ (মাশুল) স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সরকারি হিসাবের খাতায় জমা হয় না।
আমদানি-রপ্তানি পণ্যের দ্রুত ছাড়পত্র নেওয়া ও হয়রানি থেকে রেহাই পেতে আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েই বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে অতিরিক্ত টাকা উৎকোচ দেন। এই উৎকোচকে তাদের ভাষায় ‘স্পিড মানি’ বলা হয়।
আবার পাথরের কোয়ালিটি পরীক্ষা-নীরিক্ষার নামে প্রতি মেট্রিক টনে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। এক্ষেত্রে ইয়ার্ড থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট করে ছাড়পত্র দেওয়ার নিয়ম থাকলেও বুড়িমারী স্থলবন্দরে কোনো ট্রান্সশিপমেন্ট নীতিমালা মানা হয় না। এখানে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ট্রান্সশিপমেন্ট ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জালিয়াতি করে রাজস্ব ফাঁকি দিতে পণ্য আমদানির পর এইচএস কোড জালিয়াতির করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়।
স্থলবন্দর দিয়ে পাসপোর্টধারী যেসব যাত্রী ভারত, ভুটান ও নেপাল থেকে বাংলাদেশে আসেন সেসব যাত্রীর লাগেজ তল্লাশির নামে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এখন ভারতে যেতে পাসপোর্টপ্রতি পুলিশের নামে দালালদের দিতে হয় ৩০০-৫০০ টাকা। নগদ টাকা থাকলে তার একটি নির্দিষ্ট অংকের কমিশন নিয়ে নেয় তারা।
আবার আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত ট্রাকগুলো থেকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।
অন্যদিকে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের চাঁদাবাজির আরও একটি বড় খাত হলো ওজন স্টেশন। এখানে পণ্যভেদে প্রতি ট্রাক থেকে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। বেশিরভাগ ট্রাকচালকই অভিযোগ করে বলেন, টাকা নিয়ে তাদের রশিদ দেওয়া হয় না। টাকা দিতে না চাইলে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
একজন পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টাকা আদায়ের কথা স্বীকার করে জানান, অল্প কিছু নেওয়া হয়। তবে এই টাকা অফিসাররা কেউ ভাগ নেন না। সেখানে যারা কাজ করেন তারাই এই টাকা নেন।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ জানান, চাঁদাবাজরা তাদের কেউ নয়। এরা বহিরাগত। বন্দরের বাইরে একটি চক্র এই কাজ করে। আমরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবো।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, এ বন্দরে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ শতাধিক ট্রাক প্রবেশ করে। সেই হিসাবে প্রতিদিন অন্তত লক্ষাধিক টাকা চাঁদা ওঠে। মাস শেষে এ চাঁদার ভাগ চলে যায় সবার কাছে। #