নিজস্ব প্রতিবেদক ।।আদালতে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে মামলা লড়ার পর অবশেষে নিজ হাতেগড়া বিদ্যালয়ে আবারও শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন আকবর হোসেন নামে এক প্রধান শিক্ষক। বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) দুপুরে তিনি পঞ্চগড় সদর উপজেলার নয়নীবুরুজ দীঘল গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুনরায় যোগদান করেন। এ সময় বিদ্যালয়ের সাবেক সহকর্মী, ম্যানেজিং কমিটি, স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীরা আকবর আলীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পরে সবার মাঝে মিস্টি বিতরণ করা হয়।
জানা যায়, স্কুলটি প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরে আকবর আলীসহ বাকি শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হন। তার কয়েক বছর পরই তাকে বিদ্যালয় থেকে অনৈতিকভাবে বহিষ্কার করা হয় বলে দাবি করেন তিনি। তারপর থেকেই পাল্টাপাল্টি মামলা, আপিল এভাবেই চলে গেছে জীবনের ২০টি বছর। দরিদ্রতা আর মামলার হয়রানিসহ জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে তার দুশ্চিন্তার আর হতাশার মধ্য দিয়ে। অবশেষে আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছেন বলে স্বস্তি প্রকাশ করেন আকবর। তিনি পঞ্চগড় সদর উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের কাপরাঙ্গাপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
এদিকে পরিবার জানায়, দীঘল গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় ১৯৯২ সালে নয়নীবুরুজ দীঘল গ্রাম বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন আকবর আলী। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। তার অনেক আগেই সভাপতি হবিবুর রহমানের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আকবর হোসেন হয়রানি ও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। ২০০১ সালে তার স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধের একটি মামলায় তাকে তিন মাস কারাগারে থাকতে হয়। পরে সমঝোতা হওয়ায় জামিনে মুক্তি পান তিনি। তবে কারাগার থেকে বের হওয়ার পরে বিদ্যালয়ের সভাপতি হবিবুর রহমান তাকে আর বিদ্যালয়ে ঢুকতে দেননি। এভাবে কেটে যায় কয়েক বছর। পরে ২০০২ সালে স্কুলের সভাপতি তাকে বহিষ্কার করেন বলে দাবি করেন আকবর হোসেন।
২০০৪ সালে আদালতে মামলা করেন আকবর। পরে মামলায় আদালত আকবরকে স্বপদে বহাল ও তার বকেয়া বেতন পরিশোধের নির্দেশ দেন। এদিকে আকবরকে সরিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্টরা সভাপতির ভাতিজার বউ আয়েশা সিদ্দিকাকে নিয়োগ দেন।
এরপর এই মামলা গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। বেশ কয়েকবার আকবর আলী রায় পেলেও চলে পাল্টাপাল্টি আপিল। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৮ মে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ শুনানি শেষে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন এবং আয়েশা সিদ্দিকার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেন। এরপর অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া আয়েশা সিদ্দিকাকে অব্যাহতি দিলেও আকবরের যোগদান নিয়ে কালক্ষেপণ শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।
আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তারা আকবরকে ঘুরাতে থাকে। উপায় না পেয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে পঞ্চগড় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে একটি জারি মামলা করেন তিনি। এরপর আকবর আলীকে যোগদান করানোর নির্দেশ অমান্য করায় আদালত গত ২৯ অক্টোবর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে মহাপরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর তড়িঘড়ি করে বৃহস্পতিবার পঞ্চগড় সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আকবর হোসেনকে যোগদান করিয়ে বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
এ বিষয়ে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আজম আলী প্রধান বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে শিক্ষকতা শুরু করি। এই বিদ্যালয়ের জন্য তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। আকবর হোসেন ২০ বছর আদালতে মামলা লড়ে জয়লাভ করে আজ স্কুলে যোগদান করলেন। এতে আমরা অনেক আনন্দিত।’
এ বিষয়ে আকবর হোসেন বলেন, ‘এই মামলার পেছনে আমার সবকিছু শেষ। আজ পথে বসে গেছি। ছেলে দুইটাকে ভালো করে লেখাপড়া ও খাবার দিতে পারিনি। দীর্ঘ ২০ বছর পর আমি ন্যায়বিচার পেয়ে আমার প্রাণের বিদ্যালয়ে যোগদান করেছি।’